বিদেশিদের পরামর্শেই ভোটে বিএনপি জোট

মামলা-হামলা, ধরপাকড়ের মুখে নির্বাচন বর্জন করার প্রচণ্ড চাপ সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পরামর্শে শেষ পর্যন্ত ভোটে থাকছে বিএনপি ও এর মিত্র দলগুলো। অস্বাভাবিক কোনো ঘটনা না ঘটলে তারা নির্বাচন বর্জন করছে না। বিএনপি ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে।

ওই নেতারা মনে করেন, বিদেশিদের সমর্থন ছাড়া বাংলাদেশে কোনো সরকার পরিবর্তন সম্ভব নয়। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ঠেকাতে দীর্ঘমেয়াদি কঠোর আন্দোলন করা হলেও বিদেশিদের সমর্থন না থাকায় তাতে সরকারের পতন হয়নি। ফলে এবার বর্জন করে আন্দোলনের পথে না গিয়ে নির্বাচনে অংশ নিয়ে বৈদেশিক সমর্থন আদায়ের নতুন কৌশল নিয়েছে বিএনপি। দলটি মনে করে, এ প্রক্রিয়ায় বরং ভবিষ্যতে সরকারের ওপর চাপ বেশি সৃষ্টি হবে।

সর্বশেষ ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন করায় বিএনপির ভেতরে ও বাইরে নানা সমালোচনা আছে। ওই নির্বাচন বর্জন করায় আন্তর্জাতিক মহলও খুশি হয়নি। ২০১৪ সালের জুন মাসে বাংলাদেশ সফরকালে বিএনপির সঙ্গে বৈঠকে ‘নির্বাচন বর্জন কোনো সমাধান নয়’ বলে মন্তব্য করেছিলেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ। প্রায় একই সময়ে ইউরোপীয় পার্লামেন্টে গৃহীত এক প্রস্তাবে নির্বাচন বর্জন নিয়ে হতাশা প্রকাশ করা হয়েছিল। এসব ঘটনা এবার নির্বাচন বর্জন থেকে বিএনপি জোটকে দূরে রেখেছে বলে জানা যায়।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে শুরু করে প্রতিটি পদক্ষেপের বিষয়ে ঢাকাস্থ বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করে পরামর্শ করেছে বিএনপি ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। গ্রেপ্তার-নির্যাতনের ঘটনাও তারা সময়ে সময়ে জানাচ্ছে ঢাকায় বিদেশি কূটনৈতিক মিশনগুলোকে।

জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রধান নেতা ও গণফোরামের সভাপতি ড. কামাল হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের দিক থেকে নির্বাচন বর্জনের কোনো ইচ্ছা নেই। আমরা থাকব।’ তিনি আরো বলেন, ‘বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাক—এটি দেখতে চায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। ফলে আমরা নির্বাচনে টিকে থাকি—এটি তারাও চায়। তারা চায় কার্যকর গণতন্ত্র হোক।’

বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা শেষ পর্যন্ত ভোটের মাঠে লড়াইয়ে থাকব।’ তিনি বলেন, ‘সরকার পরিস্থিতি বিএনপির জন্য প্রতিকূল তৈরি করেছে। নির্বাচন কমিশনও লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করেনি। কিন্তু তা সত্ত্বেও সরকারের স্বরূপ উন্মোচনের জন্য ভোটে আছি। তা ছাড়া আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও দেখুক বর্তমান সরকারের অধীনে কী ধরনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।’ বিএনপির অন্যতম এই নীতিনির্ধারক বলেন, ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চায় এবং এও চায় যে আমরা নির্বাচনে থাকি।’

প্রশ্ন উত্থাপন করে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘নির্বাচন বর্জন কেন করব? আমরা নির্বাচনে আছি। কারণ বর্তমান সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব কি না, এটাও বিশ্বসম্প্রদায়ের দেখার প্রয়োজন রয়েছে।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বিশ্বের যেসব দেশ বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী দেখতে চায়, তারাই বারবার অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথা বলেছে। ফলে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ক্ষেত্রে অনিয়ম বা ভোট ডাকাতি হলে সে বিষয়টিও তারা পর্যবেক্ষণে রাখবে বলে আমরা মনে করি।’

কূটনৈতিক ক্ষেত্রে ভূমিকা পালনকারী বিএনপির প্রভাবশালী এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আসলে বিএনপিকে নির্বাচনে টিকে থাকার পরামর্শ ঢাকাস্থ বিদেশি কূটনীতিকদের পাশাপাশি শক্তিধর কয়েকটি দেশের তরফ থেকেই দেওয়া হয়েছে। তা ছাড়া আন্দোলন করে সরকার ফেলার দিন এখন শেষ। ফলে তারা (আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়) যা বলে, সে অনুযায়ীই কাজ করতে হয়।’

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘নির্বাচনে আমাদের টিকে থাকতে হবে। এ ছাড়া আর উপায় নেই। তবে এটাও ঠিক যে বিদেশিরা এ নির্বাচন দেখবে এবং বিবৃতি দেবে। এরই মধ্যে তারা হতবাক হয়ে গেছে। কিন্তু চূড়ান্তভাবে তারা কী করবে এটি নির্ভর করছে জনগণ কী প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে তার ওপর।’

প্রায় এক যুগ ধরে লন্ডনে বসবাস করছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমান। গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে একটি দুর্নীতি মামলায় কারাগারে নেওয়া হয় দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে। দলীয় সূত্রে জানা যায়, এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ নিয়ে সংশয় ছিল। কিন্তু জনমত পক্ষে আছে—এমন বিবেচনায় শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেয় দলটি।

সূত্র মতে, বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের প্রথম হিসাব ছিল—নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর পরিস্থিতির বদল হবে। অন্তত প্রশাসন কিছুটা হলেও নিরপেক্ষ হবে—এমন আশাবাদ ছিল তাঁদের। কিন্তু দলীয় ও জোটের প্রার্থীদের ওপর হামলা ও গ্রেপ্তারে তাঁদের মধ্যে হতাশা দেখা দেয়। নির্বাচন কমিশনের (ইসি) ওপর ঘন ঘন চাপ তৈরির চেষ্টা করেও তাঁরা ব্যর্থ হন। এরপর বিএনপি ও জোটের নেতারা মনে করতে থাকেন যে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হলে পরিস্থিতির বদল হবে এবং তাঁরা নির্বিঘ্নে প্রচার চালাতে পারবেন।

কিন্তু কার্যত তাঁদের সেই প্রত্যাশাও পূরণ হয়নি। ফলে গত ২৪ ডিসেম্বর সেনাবাহিনী মোতায়েন করার পর নির্বাচনে থাকা না থাকা নিয়ে নতুন করে আলোচনা ওঠে বিএনপি ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতাদের মধ্যে। কিন্তু ২৭ ডিসেম্বর ঐক্যফ্রন্টের বৈঠকে খোলামেলা আলোচনা ছাড়াই বিএনপি জানায়, তারা নির্বাচনে থাকবে। এরপর শরিক দলগুলোও ওই সিদ্ধান্তের পক্ষে মত দেয়। কিন্তু নির্বাচনে থাকার কারণ সম্পর্কে ঐক্যফ্রন্টের বৈঠকে কোনো আলোচনা হয়নি।

নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়, নির্বাচনে টিকে থাকার কারণ খোলাসা করতে চাননি বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতারা। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পরামর্শের বিষয়টি তাঁরা গোপন রাখেন, যদিও নির্বাচনে টিকে থাকতে গিয়ে সার্বিকভাবে বিএনপি জোট প্রচণ্ড চাপে আছে। গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, আদালতের রায়ে বিএনপির প্রার্থী শূন্য হয়েছে ১৭টি আসনে।

এ ছাড়া আরো তিনটি আসনে গতকাল স্বতন্ত্র প্রার্থীকে সমর্থন দিয়েছে বিএনপি। আসনগুলো হলো ঢাকা-১ (সালমা ইসলাম), জয়পুরহাট-১ (আলেয়া বেগম) ও বগুড়া-৭ (রেজাউল করিম বাবলু)। এর বাইরে গণফোরামের আরো তিন প্রার্থীকে গতকাল সমর্থন জানিয়েছে বিএনপি ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। আসনগুলো হলো জামালপুর-১ (সিরাজুল হক), মানিকগঞ্জ-৩ (মফিজুল ইসলাম) ও সিলেট-২ (মো. মোকাব্বির)।

বিএনপির দেওয়া তথ্য মতে, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে গতকাল পর্যন্ত তাদের ১০ হাজারের বেশি নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং ১৭ জন প্রার্থী কারাগারে রয়েছেন। দলটির শত শত নেতাকর্মী পালিয়ে বেড়াচ্ছে। অনেক প্রার্থী নিজের বাড়িতে অবরুদ্ধ আছেন। এ অবস্থার মধ্যে বিএনপি জোটের নির্বাচনে টিকে থাকা নিয়ে জনমনে ব্যাপক কৌতূহল তৈরি হয়েছে।–কালেরকন্ঠ